www.chini24.online

www.chini24.online detailed reporting and presentation of information about current events, issues, or stories.

Subscribe Us

Tuesday, 18 February 2025

ব্যাংকিং সেক্টরের বিপর্যয় : ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই

 

ব্যাংকিং সেক্টরকে একটি দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। ব্যাংকিং সেক্টর যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তাহলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশের প্রতিটি সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টর।

দলীয়করণ, আত্মীয়করণ এবং ব্যাপক মাত্রায় দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

পাচার করা টাকায় দুবাইতে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে ৩ হাজার ৬০০টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্ণিত সময়ে রাজনীতিবিদরা ঘুষগ্রহণ করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, আমলারা ঘুষ নিয়েছেন ৯৮ হাজার কোটি টাকা।

শেয়ারবাজার থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ঘুষ এবং কমিশন বাবদ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা। প্রতিবছর জিডিপির ৩ শতাংশের সমান অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

পাচার করা এই অর্থের বিরাট অংশই এসেছে ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটের মাধ্যমে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিগত ১৫ বছরে ২৪টি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একটি মহল নানা উপায়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ উপার্জন এবং পাচার করেছে। গত ১৫ বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মাত্রা এবং প্রবণতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পায়।

২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে তা দাড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ দৃষ্টে একটি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বাস্তব অবস্থা অনুমান করা যায়। বিগত সরকারের আমলে কিস্তি আদায় না করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ‘এক টাকাও’ বৃদ্ধি পাবে না।

এরপর দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলোকে এমনভাবে পরিবর্তন এবং সংশোধন করা হয়, যাতে কিস্তি আদায় না করেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানো যায়।

গত সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা প্রদর্শন করা হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি । বাংলাদেশের ইতিহাসে আ হ ম মোস্তফা কামাল ছাড়া আর কোনো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাননি।

অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর মোস্তফা কামাল ঋণখেলাপি এবং অসৎ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ব্যাংকিং আইনগুলো পরিবর্তন করতে থাকেন। বর্তমানে যেসব আইনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টর পরিচালিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের আইনগুলো কীভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের এক বছরপূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অজুহাতে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করা হয়। এটি ছিল আসলে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ।

মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করা হয়। ১১টি শিল্পগোষ্ঠী এই সুযোগ নিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে নেয়। অভিযোগ রয়েছে, এই বিতর্কিত আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পেছনে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ভূমিকা পালন করেন। যে শিল্পগোষ্ঠীগুলো এই আইনের আওতায় তাদের ঋণ হিসাব নিয়মিতকরণের সুবিধা গ্রহণ করেন, পরে তাদের অধিকাংশই আবার খেলাপিতে পরিণত হয়।

২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এককালীন জমা দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে ঢালাওভাবে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ শুরু হয়।

আগে কোনো ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলীকরণ করা যেত। প্রথমবারের জন্য ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বারের জন্য ২০ এবং তৃতীয়বারের জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো।

ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ করা হলে সেই ঋণ হিসাবকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের খেলাপি ঋণ হিসাব নিয়মিতকরণ করে নেয়। বর্তমানে পুনঃতফসিলীকরণ করা ঋণ হিসাবের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা।

আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দামানে শ্রেণীকৃত হওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা-পূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে সেই ঋণ হিসাবকে অবলোপন করা যেত। কিন্তু এই আইন পরিবর্তন করে প্রথমে তিন বছর এবং পরে দুই বছর মন্দামানে শ্রেণীকৃত থাকার পরই একটি ঋণ হিসাব অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়।

হিসাবের কাছে পাওনা ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার কম হলে মামলার কোনো শর্ত থাকবে না। এ ছাড়া শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধানও প্রত্যাহার করা হয়। জুন মাসের হিসাব মোতাবেক অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা ছিল ৭৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। বিশেষ হিসাবে ছিল ৩৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।

আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় ছিল ৭৬ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা খেলাপি হলেও তাকে খেলাপি ঋণ হিসাবে প্রদর্শন করা হয়নি।

ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একই পরিবার থেকে একযোগে চারজন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়। তারা অব্যাহতভাবে তিন টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) অর্থাৎ ৯ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

পরে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণগ্রহণের সময় আরোপিত শর্ত মোতাবেক একই পরিবার থেকে পরিচালক নিয়োগের সংখ্যা কমিয়ে তিনজনে নিয়ে আসা হয়। আইএমএফের শর্ত মোতাবেক ব্যাংক খাতের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার জন্য আইনপ্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেই আইনের কোনো প্রয়োগ এখনো পর্যন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে না।

বিগত সরকারের পতনের কিছুদিন আগে একটি আইনি পরিবর্তন করা হয়। আগে কোনো শিল্পগোষ্ঠীর একটি মাত্র প্রকল্প ঋণখেলাপি হলে অবশিষ্ট প্রকল্পগুলোর অনুকূলে কোনো ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করা হতো না। পরিবর্তিত আইনের মাধ্যমে একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর কোনো প্রকল্প ঋণখেলাপি হলেও অবশিষ্ট প্রকল্পের নামে ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আইন করে সরকার সমর্থক দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠীকে অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলেও অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছিল। তারা চেক ব্যাংকে জমা দিলে অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ না থাকলেও তাদের চেক ডিজঅনার হতো না। ব্যাংকগুলো চেকের বিপরীতে টাকা দিত। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে পরিশোধ করত।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

No comments:

Post a Comment

Powered by Blogger.

Search This Blog

About Us

About Us
Lorem Ipsum is simply dummy text of the printing and typesetting industry. Lorem Ipsum has been the industry's.

Editors Choice

3/recent/post-list